বর্তমানকালে প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত উপায়-উপাদানের মধ্যে দক্ষ ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে সকল মহলেই স্বীকৃত । একই স্থানে একই পরিমাণে অর্থ ও উপাদান বিনিয়োগের পরও দু'জন ব্যবসায়ীর মধ্যে সফলতা অর্জনে যে পার্থক্য লক্ষ করা যায় তার মধ্যে মূল পার্থক্য নির্ধারণকারী উপাদান হলো ব্যবস্থাপকের গুণাবলির ভিন্নতা । ব্যবসায়ের সফলতার জন্য একজন ব্যবস্থাপকের যে সকল গুণ কম-বেশি থাকা উচিত তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো :
১. সাধারণ শিক্ষা ও জ্ঞান (General education and knowledge) : বৃহদায়তন প্রতিষ্ঠানের একজন ব্যবস্থাপককে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করতে হলে তার উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত ও জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া উচিত । সাংগঠনিক পরিচালনা সম্পর্কিত জ্ঞান একজন ব্যবস্থাপককে তার কাজ সঠিকভাবে সম্পাদনে সহায়তা করে ।
২. অভিজ্ঞতা (Experience) : অভিজ্ঞতা বলতে কাজের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত থেকে অর্জিত ও লব্ধ জ্ঞানকে বুঝায় । ব্যবস্থাপনা একদিকে কলা ও অন্যদিকে বিজ্ঞান। তাই কলা হিসেবে একজন ব্যবস্থাপকের প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা থাকা অপরিহার্য। বিভিন্ন সমস্যা মোকাবিলা ও কার্যকলাপের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা একজন ব্যবস্থাপককে পূর্ণতা দান করে । শিক্ষিত কম হওয়ার পরও যারা ব্যবসায়ে ভালো করছেন, এটা সম্ভব হয়েছে তাদের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কারণেই ।
৩. শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য (Physical and mental abilities) : শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, শক্তি ও দৃঢ়তাকে এ ধরনের যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় । একজন ব্যবস্থাপককে বিশেষত শীর্ষ নির্বাহীদের ক্ষেত্রবিশেষে ২৪ ঘন্টা কাজ করতে হয় । তাই কর্তব্য কাজে তাদের যথেষ্ট পরিশ্রমী হওয়া আবশ্যক । সেই সাথে নানা প্রতিকূল অবস্থা ও ঝামেলার মধ্যে তাকে চলার জন্য যথেষ্ট মানসিক ভারসাম্যপূর্ণ ও দৃঢ় হওয়ার প্রয়োজন পড়ে । অন্যথায় দক্ষতার সাথে ব্যবস্থাপনা কার্য পরিচালনা তার পক্ষে সম্ভব হয় না ।
৪. আন্তরিকতা ও সংকল্পবদ্ধতা (Sincerity and determination) : কোনো কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং কর্তব্য-কাজে একাগ্র ও মনোযোগী হলে তাকে আন্তরিকতা বলে । একজন ব্যবস্থাপক যদি তার কর্তব্য কাজে আন্তরিক না হয় এবং কাজের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে না পারে তবে তার পক্ষে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া সম্ভব নয় । সেই সাথে একজন ব্যবস্থাপক এ পেশায় ব্যক্তিক উন্নয়নের ব্যপারে সংকল্পবদ্ধ না হলে তার পক্ষে ভালো ব্যবস্থাপক হওয়া সম্ভব হয় না । এরূপ গুণ থাকলে অনেক কম যোগ্য ব্যক্তিও নিজস্ব পেশায় ভালো করতে পারে ।
৫. যোগাযোগ দক্ষতা (Communicative skill) : অন্যের বা অন্যদের নিকট সঠিক সময়ে সঠিক উপায় বা পদ্ধতিতে নিজের বক্তব্য কার্যকরভাবে তুলে ধরে উদ্দেশ্য অর্জনের সামর্থ্যকে যোগাযোগ দক্ষতা বলে । বিভিন্ন পক্ষের সাথে যোগাযোগ রক্ষা ও কাজ আদায়ে একজন ব্যবস্থাপকের যোগাযোগ দক্ষতা থাকতে হয় । যে ব্যবস্থাপক সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সাথে যতবেশি যোগাযোগ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন কার্যক্ষেত্রে তার পক্ষেই ততবেশি কার্যকর ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়ে থাকে । তাই সকল অবস্থায় যোগাযোগ রক্ষার মাধ্যমে সঠিক তথ্য জানা ও জানানো এবং সহজে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে লক্ষ্যার্জনের গুণ ব্যবস্থাপকের থাকা উচিত ।
৬. অনুপ্রাণিত করার ক্ষমতা (Power to motivate) : অনুপ্রাণিত করা বলতে অন্যদেরকে উৎসাহিত, শক্তি সঞ্চারিত ও কাজে উদ্দীপ্ত করাকে বুঝায় । ব্যবস্থাপনার কাজ হলো অন্যদের দ্বারা প্রয়োজনীয় কাজ সম্পাদন করিয়ে নেয়া । এরূপ কাজ সম্পাদনের নিমিত্তে সংশ্লিষ্টদের অনুপ্রাণিত করা অপরিহার্য । তাই সহজে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে ও বাইরে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষকে অনুপ্রাণিত ও প্ররোচিত করার ক্ষমতা ব্যবস্থাপকের একটি অন্যতম গুণ হিসেবে বিবেচিত ।
৭. প্রজ্ঞা বা দূরদর্শী (Fore-sight) : জ্ঞানচক্ষু বা বিশেষ জ্ঞান দ্বারা ভবিষ্যৎকে উপলব্ধি বা বুঝতে পারার সামর্থ্যকে প্রজ্ঞা বা দূরদর্শী বলে । একজন ব্যবস্থাপককে সব সময়ই পূর্বানুমানের ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নিতে হয় । তাই ব্যবস্থাপক যদি বর্তমান অবস্থা ও পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সঠিক অনুমান করতে ব্যর্থ হয় তবে তার পক্ষে কার্যকর পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হয় না । একজন দূরদর্শী প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি যোগ্য ও সফল ব্যবস্থাপক হিসেবে সহজেই প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে ।
৮. তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তা (Sharp intelligence) : বোধশক্তি, বিচারশক্তি, জ্ঞান ও মেধাশক্তির সম্মিলিত রূপকে বুদ্ধিমত্তা বলে । একজন ব্যবস্থাপককে সকল অবস্থায় সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্রুত সামনে এগিয়ে যেতে তীক্ষ্ণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হওয়া প্রয়োজন । সকল পক্ষের সাথে উত্তম সম্পর্ক বজায় রেখে দ্রুত লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য তাই প্রয়োজনীয় বুদ্ধিমত্তার অধিকারী হওয়া ব্যবস্থাপকের একটি অন্যতম গুণ ।
৯. সাহসিকতা (Courage) : যে কোনো পরিস্থিতিতে ভীত না হয়ে বুদ্ধিমত্তার সাথে সামনে এগিয়ে যাওয়ার গুণকেই সাহসিকতা বলে । ব্যবসায়ের সাথে ঝুঁকি সব সময়ই জড়িত । যে কোনো নতুন উদ্যোগ ও পরিকল্পনা গ্রহণে ঝুঁকি ও অনিশ্চয়তা বিদ্যমান থাকে । তারপরও ব্যবসায় পরিচালনায় অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক নানারূপ বিপত্তি লক্ষ করা যায় । সকল অবস্থায় দক্ষতার সাথে ব্যবসায় পরিচালনার জন্য অবশ্যই ব্যবস্থাপককে যথেষ্ট সাহসী হতে হয় ।
১০. সংযত ব্যক্তিত্ব (Pleasant personality) : চিন্তা, কথা, কাজ ও আচরণে কোনো ব্যক্তি ভদ্র, মার্জিত, বিনয়ী, দৃঢ় ও আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন হলে অন্যের নিকট ব্যক্তির যে আকর্ষণীয় রূপের বহিঃপ্রকাশ ঘটে তাকে ব্যক্তিত্ব বলে । বিচিত্র মনের কর্মী ও বিচিত্র পরিবেশের মধ্যেও সবদিক বজায় রেখে চলতে হলে ব্যবস্থাপককে অবশ্যই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে । যা অন্যদের নিকট ব্যবস্থাপককে আকর্ষণীয় করে তোলে ।
উপসংহারে বলা যায়, অন্যকে দিয়ে পরিকল্পিত উপায়ে যথাযথভাবে কাজ করাতে হলে একজন ব্যবস্থাপকের উপরোক্ত গুণাবলি থাকা আবশ্যক । যে ব্যবস্থাপকের মধ্যে উপরোক্ত গুণাবলির সমাহার বেশি ঘটে কার্যক্ষেত্রে তার পক্ষেই তত বেশি সফলতা অর্জন সম্ভব হয়।